কলমের ইতিহাস শুধু একটি লেখার যন্ত্রের বিবর্তন নয়, রহস্যময় কালির ডগায় লুকিয়ে থাকা কলমের ইতিহাস। এটি মানব সভ্যতার বিকাশের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। গুহামানবের গুহা চিত্র থেকে শুরু করে আধুনিক জেল পেন পর্যন্ত, কলম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
আমাদের জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে কলম হচ্ছে অন্যতম । কলম হচ্ছে এমন একটি জিনিস যার ব্যবহার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
স্কুল বলেন কলেজ বলেন অফিস আদালত বা বাজারের ক্ষেত্রেও আমরা কলমের ব্যবহার দেখতে পাই। যদিও এখন আমরা যে কলম ব্যবহার করে থাকি।
প্রাচীনকালে কলম এরকম ছিল না। বিশ্ব যেরকম আধুনিক হচ্ছে সেরকমই আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে কলমের ধরনেরও পরিবর্তন হচ্ছে ।দিন দিন আধুনিক হচ্ছে কলম।
যদিও কলম ব্যবহারের অনেকটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে ল্যাপটপ কম্পিউটার এবং মোবাইল। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায় কলমের ব্যবহার এখনো অনেকটাই রয়েছে। আমরা কি জানি এই কলম কখন এবং কেন আবিষ্কার হয়েছিল?
চলুন একটু পড়ে আসি রহস্যময় কালির ডগায় লুকিয়ে থাকা কলমের ইতিহাস এবং আধুনিক যুগের বিভিন্ন কলমের ব্যবহার।
- কলমের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিকতা
আদিম যুগে মানুষ যখন পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত। তখন মনের ভাব প্রকাশের জন্য গুহার দেয়ালে কোন সূক্ষ্ম জিনিস দিয়ে ছবি আঁকতো ।আবার অনেক সময় গাছের পাতার রস বা শিকরের রক্ত দিয়ে আঁকিবুকি করত । তার অনেক শতাব্দি পর মানুষ যখন কিছুটা সভ্য হতে শুরু করল।
তখন কাদা মাটির পাতায় লিখতে শুরু করল।কলমের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো ধারণা করা যায় প্রাচীন মিশরীরা সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার শুরু করে।
সে সময় অবশ্যই আজকের মত মসৃণ কোন কাগজ ছিল না। সে সময় লেখালেখি করা হতো বিভিন্ন কাগজের পাতা বা কল এবং পশুর চামড়ার কলম হিসেবে তারা ব্যবহার করত ।নলখাগড়া সর বা বিনু বাসের কঞ্চি অথবা ফাঁকা খন্ড এসব খণ্ডকলম এর মত করে কেটে সুচালো করা হতো ।
সূচালো অংশটি কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হতো কালিও ছিল বিভিন্ন গাছের রস এবং বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা প্রস্তুত ।নলখাগড়া জাতীয় কলমের ব্যবহার চললে বহুকাল দীর্ঘকাল পর প্রায় ৫ শতকের দিকে এসে কঞ্চি বা নলখাগড়ার জায়গা দখল করে। পাখির পালক রাজহাঁসের পালক ছিল সে যুগের কলম তৈরির প্রধান উপকরণ। পালকের মাথা শুক্ষভাবে সূচনা করা হতো যাতে লিখতে সুবিধা হয়।
|
নিব কলম
সাধারণত কাঠের হাতলের সাথে একটি ধাতব নীপ লাগিয়ে ওই কলম তৈরি করা হয় ।তবে এই কলমের কোন কালি জমা রাখার উপযোগী কালিদানি নেই এবং লেখা সময়ে বার বার এটিকে চুবিয়ে নিতে হয়।
ঝরনা কলমের তুলনায় এই কলমে সুবিধা হল এই কলমের ঘন কালি এবং ধাতবকালে ব্যবহার করা যায়। যা ঝর্ণা কলমে জমে গিয়ে আটকে যায় অথবা মরিচা পড়ে যায়। নিপলম এখন প্রধানত অলংকরণ চারুলিপি এবং কমিকস আকাঁর কাজে ব্যবহার করা হয়।
খাগের কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
খাগড়া এক ধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ এটিকে অনেক সময় নলখাগড়া বলা হয়ে থাকে। এই খাগড়ার একদিকে শুরু করে কেটে ওই কলম তৈরি করা হতো ।এই কলমের দৈর্ঘ্য ছিল ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি এই লিখন পদ্ধতি অনেকটা কুইলের মত। এর মাঝে ফাঁকা অংশে কালি ভরা হত একবার কালি ভরলে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা অনায়েসে লেখা যেত। সে সময় খাগের কলমের বিভিন্ন রকম প্রকার ছিল ।
- বাঁশের কঞ্চির কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
কলমের বিবর্তন ইতিহাসে এমন একটি সময় ছিল ।যখন বাঁশের কঞ্চি দিয়েও কলম তৈরি করা হতো ।বাঁশের কঞ্চির কলমের ব্যবহার ছিল বন কলমে সমসাময়িক কালেক্ট এর ব্যবহার অল্প কিছু দিনকাল আগেও চোখে পড়তো ।
বাঁশের কঞ্চি কে পাঁচ থেকে সাত ইঞ্চি লম্বা করে কেটে এর এক প্রান্ত তীক্ষ্ণভাবে সূচালো করা হতো। কঞ্চির মাঝখানের ফাঁকা অংশ খালি ভরে লেখালেখি করা হতো। কালি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় কালি ভরে নেওয়া হতো।
- পাখির পালকের কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
পাখির পালক দ্বারা তৈরি কলমকে উইং কলম বলা হয় ।সাধারণত রাজহাঁসের পালক দ্বারা বা বড়সড়ো পাখির পালক তারা এই ধরনের কলম তৈরি করা হয়।
নেট কলম বা ঝরনা কলম আসার আগে কুইল ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় ।এই কলম তৈরীর উদ্দেশ্যে বসন্তের সময় পাখির ডানার শেষ পাঁচ ছয়টি পালক তুলে নেওয়া হতো। সাধারণত পাখির বাম ডানার পালক বেশি ব্যবহার হতো।
কারণ এগুলো বামদিক থেকে বাইরের দিকে একটু বাঁকানো থাকে। যার কারণে ডান হাতি লেখক এর জন্য ব্যবহার করা সহজ হতো ।পালকের মাঝখানে যে ফাঁকা অংশ থাকে সেটা কালিদানের হিসেবে কাজ করে।
ঐশী পরিচালক প্রক্রিয়ায় কালীর পরিচালন হত কোয়েল বা পাখির পালকের ব্যবহার মধ্যযুগে বেশ জনপ্রিয় ছিল। মধ্যযুগে চামড়ার কাগজের উপর এই কলম দ্বারা লেখা হতো পালকের কলম আসার পরে খাগড়া কলমের ব্যবহার কমে যায় ।এরপর পর্যায়ক্রমে নলখাগড়ার কলম বিলুপ্তি হয়ে যায়।
- কালির কলম
কালির কলম সাধারণত এশিয়া লিপিবিদদের মধ্যে ঐতিহাসগত ভাবে এই কলম ব্যবহার করার প্রচলন দেখা গিয়েছে। এ ধরনের কলমকে ব্রাশ বা বুরুশ বলা হয়। কলমের মূল অংশটি সাধারণত বাশ দিয়ে তৈরি করা হতো।
এছাড়া বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে দুর্লভ উপকরণ যেমন লাল চন্দন গাছ হাতির দাঁত সোনা রুপা ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো ।কলমের শীর্ষ ভাগের ব্রাশটি তৈরি করা হতো বিভিন্ন পাখির পালক বা বিভিন্ন পশুর লোম দ্বারা। এক কালে চীন এবং জাপানের নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের মাথার চুল দ্বারা এই বুরুশ তৈরি করা হতো।
- আধুনিক কলমের ইতিহাস
আধুনিক কলম তৈরির এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ।আধুনিক কালে সর্বপ্রথম ১৭৮০ সালে ইংল্যান্ডে কলমের আবিষ্কার হয় ।এরপর ১৮৮৫ সালে ওয়াটার ম্যান আবিষ্কার করেন ফাউন্টেন পেন ।
তখন এর নেট তৈরি করা হতো ১৪ ক্যারেট সোনা এবং ডগা তৈরিতে লাগতো ইউডিয়াম।এরপর ইংল্যান্ড ছাড়াও বিভিন্ন দেশে ফাউন্টেন প্যান্ট তৈরি হতে শুরু করে।
বিশ্ব শতাব্দীতে এসে তৈরি হয় বল পয়েন্ট বা বলপেন সর্বপ্রথম বলপেন আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর । জন লাউড নামক একজন পত্রিকার সম্পাদক সর্বপ্রথম এই কলম আবিষ্কার করেন ।তবে তার এই আবিষ্কার স্বীকৃতি পায় হাজার ১৯৪৩ সালের লেডিসলাস বির এবং তার ভাই জর্জের হাত ধরে বলপয়েন্ট বাজারজাতকৃত হয় এবং আবিষ্কারের স্বীকৃতি পায়।
- বল পয়েন্ট কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
এই কলমে ডগায় বা নিবে ০.৭ থেকে ১.২ মি .মি আকারের পিতল স্টীল বা টাংস্টেন কার্বাইডের তৈরি একটি ছোট শক্ত বল বা গোলক থাকে যা কলমের ভেতরে থাকা কালিকে কাগজ বা যার উপরে লেখা হচ্ছে তাতে মাখাতে সাহায্য করে।
বল পয়েন্ট কলমে যে কালি ব্যবহার করা হয় তাই একটু ঘন প্রকৃতির এবং তা কাগজের সংস্পর্শে আসতে না আসতে শুকিয়ে যায় এই নির্ভরযোগ্য কলম গুলির দামও খুব কম। ফলে সহজেই নিত্যদিনের লেখালেখির কাগজে বল পয়েন্ট কলম সবচেয়ে জনপ্রিয় উপকরণ হয়ে উঠেছে
- জেল পেন
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
এই কলমের ডগাও বল পয়েন্টের কলমের মতো বল থাকে । কিন্তু এই কলমের কালি বল পয়েন্ট কলমের কালির চেয়ে পাতলা বা কম ঘন। এই কলম ঘন কালি সহজেই কাগজ শুকিয়ে নিতে পারে এবং কলমও অনেক মসৃণ ভাবে চলতে পারে।
বল পয়েন্ট কলমে সুবিধা এবং ঝর্ণা কলমের কালির ভাবটাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে জেল কলমের সূত্রপাত হয়েছিল ।জেল কালি বিভিন্ন রঙের হয় এমনকি ধাত ব পেইন্ট বা ঝিকিমিকি রঙেরও জেল কালি পাওয়া যায়।
- ঝরনা কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
ঝরনা কলম এই কলমের পানি ভিত্তিক তরল কালি দিয়ে নিবের সাহায্যে লেখা হয়। কলমের ভিতর কালিদানিতে থাকাকালী কৈশিক পরিচালক প্রক্রিয়ায় এবং অভিকর্ষের সাহায্যে নিবের মাধ্যমে বাইরে আসে। এই নিবের কোন নড়নক্ষম অংশ থাকে না ।
এটাকে চিকন ফাটল দিয়ে কালি বেরিয়ে আসে ভেতরের কালিদানিতে কালি শেষ হয়ে গেলে দোয়া থেকে আবার কালি ভরা যায়। অনেকে মনে করেন ফাউন্টেন এর বাংলা তরজমা ঝরনা কলম নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন ।
- মার্কার কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
- কাগজের কলম
ছবির সংগ্রহ : ইন্টারনেট থেকে |
FAQ (Frequently Asked Questions)
কলমের প্রথম আবিষ্কার কখন হয়েছিল?
- কলমের প্রথম ব্যবহার প্রায় ৫ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয়দের দ্বারা শুরু হয়েছিল।
নলখাগড়া কলম কী?
- নলখাগড়া কলম এক ধরনের প্রাচীন কলম, যা নলখাগড়া গাছের কাঠি দিয়ে তৈরি হতো। এটি কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হতো।
ফাউন্টেন পেনের প্রথম আবিষ্কার কে করেছিলেন?
- ফাউন্টেন পেনের প্রথম আবিষ্কার করেন ওয়াটার ম্যান ১৮৮৫ সালে।
বল পয়েন্ট কলমের আবিষ্কার কবে হয়?
- বল পয়েন্ট কলম প্রথম আবিষ্কার হয় ১৮৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর, জন লাউড দ্বারা।
পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম কী?
- পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম হলো এমন একটি কলম যা প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাগজ দিয়ে তৈরি হয় এবং এর মধ্যে ফল বা সবজির বীজ থাকে, যা মাটিতে পুতে দিলে নতুন গাছ জন্মাতে পারে।
ঝরনা কলমের বাংলা নাম কে দিয়েছিলেন?
- ঝরনা কলমের বাংলা নাম 'ফাউন্টেন পেন' হতে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
মার্কার কলমের ব্যবহার কীভাবে হয়?
- মার্কার কলমের আঁশ জাতীয় পদার্থের তৈরি স্পঞ্জের মত ডগা থাকে, যা সাধারণত কাগজ, হোয়াইট বোর্ড, এবং প্যাকেজিংয়ের উপর লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়।
Thank you so much for your comment, if you need tuition knock us on 01988325330